হিন্দুদের সমস্যা – কিছু ভাবনা

কিছু দিন শান্ত থাকার পর বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। আমার ছোট বেলায় এমনটা যে হত না তা নয়, তবে তখন এসব হত কোন ঘটনার যেমন ইন্ডিয়ায় মুসলিমদের উপর আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। বর্তমান বাংলাদেশে উগ্রবাদীরা আর ইন্ডিয়ার জন্য অপেক্ষা করে না, হিন্দুরা ভোট দিল কি না, এসব বিবেচনায় নিয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালায়। গণজাগরণ মঞ্চের পর থেকে এর সাথে এক নতুন মাত্র যোগ হযেছে। সেটা হলো ফেসবুক বা অন্য কোন সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন লেখা তুলে তারপর আক্রমণ চালানো। তবে এ লেখা কে লিখল, এটা সত্য না মিথ্যে – সেটা যাচাই করার প্রয়োজন তারা বোধ করে না। ভাবখানা এই যে তারা আগে থেকেই জানে কে লিখেছে আর কি লিখেছে। তারপর গ্রামের লোকদের উস্কানি দিয়ে হিন্দুদের উপর হামলা চালানো হয়। সরকার, বিরোধীদল আর অন্য সবার একরকম নির্লিপ্ততার মধ্য দিয়ে এসব চলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। এ ব্যাপারে কি আমার, আমাদের কিছুই বলার নেই? ছাত্র ইউনিয়নের প্রাক্তন কর্মী, প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে আগে ভাবতাম কি দরকার এসব সাম্প্রদায়িক ব্যাপরে কথা বলে। বন্ধুরা তো আবার আমাকে সাম্প্রদায়িক ভেবে বসবে। তবে পরে বুঝলাম যে এই ধারণা ভুল, আমি তো লিখছি বা প্রতিবাদ করছি আমি হিন্দু বলে না, আমি প্রতিবাদ করছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, এই প্রতিবাদ নিয়ে আমি নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে এসে দাড়াচ্ছি – সাম্যবাদে বিশ্বাসী হিসেবে এটা তো আমার এক নম্বর কাজ।

যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রথমে তার কারণগুলো বোঝা দরকার – তা সে পদার্থবিদ্যারই হোক, আর সমাজেরই হোক। কিছু সমস্যা থাকে এক্সটার্নাল আর কিছু ইন্টারনাল। এক্সটার্নাল সমস্যাগুলো বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া, যেমন উগ্রপন্থীদের আক্রমন, ইন্টারনালগুলো নিজেদের সামাজিক অবকাঠামোর সাথে জড়িত। তবে এরা দুটোই পরস্পরের সাথে জাড়িত। যদি অবকাঠামো ফ্লেক্সিবল হয়, তবে অনেক আঘাতেও তাকে ভাঙ্গা কষ্ট। বয়স্ক মানুষ অনেক আঘাত সহ্য করতে পারে, তবে একটা পর্যায় পেরুলে ভেঙ্গে পড়ে, শিশু কিন্তু ভাঙ্গে না, মচকায়। একই ভাবে বয়স্ক মানুষ একটা সময়ের পর বড় হয় না, শিশু বড় হয়, কেননা আর অবকাঠামো, হাড় ফ্লেক্সিবল। তাই আমাদের প্রথমেই দেখা দরকার হিন্দু সমাজের কিসব দুর্বল জায়গা আছে যা ভেতর থেকে তাদের ক্ষয় করে দেয়। সেগুলো দূর না করে বাইরের কারণগুলোর সাথে যতই লড়াই করি না কেন, সমাজের অবক্ষয় তাতে বন্ধ হবে না।

এখানে আরো একটা কথা বলা দরকার, বিশেষ করে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের উদ্দেশ্যে – আমি এখানে হিন্দুদের কথা বলছি – যারা বাবরী মসজিদ ভাঙ্গে বা অন্যান্য ভাবে অন্য ধর্মের লোকদের হেনস্তা করে। গীতাতেই তো বলা আছে, “যখন ধর্মের পতন ঘটে আর অধর্মের অভ্যুথান হয়, তখনই আমি সাধুদের পরিত্রাণ আর অসাধুদের বিনাশ করার জন্য, ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য আবির্ভূত হই।” তাই এই যে আপনারা ধর্ম গেল বলে যেসব কাজ করছেন, তা করার অধিকার কি আপনাদের আদৌ আছে? আপনারা শুধু আপনাদের ধর্মটুকু পালন করুন, আর ধর্ম রক্ষার ব্যাপারটা কৃষ্ণের হাতে ছেড়ে দিন, দেখবেন অনেক সমস্যা এমনিতেই দূর হয়ে যাবে। এ কথাটা আমাদের সমাজের কর্মকর্তা যারা কথায় কথায় একে ওকে একঘরে করেন, তাদের জন্যও সত্য। কৃষ্ণই বলেছেন “তুমি তোমার কর্ম করে যাও, ফলের চিন্তা করো না” – আমরা সবাই যদি আমাদের কাজ করে যাই, শিক্ষক পড়াই, ছাত্র পড়ি, কৃষক চাষ করি, যে যার পেশা অনুযায়ী নিজের কাজ করে যাই, দেখবেন তাহলেই সমাজটা কেমন ভাল হয়ে যায়। আর এসব করার জন্য, বাইরের আঘাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য যে কাজগুলো দ্রুত করা দরকার সেগুলো হলো:

ক) সমাজের ভিতরে বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে যে বৈষম্য বিরাজমান তা দূর করা;
খ) সামাজিক ভাবে মেয়েদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা;
গ) হিন্দু সমাজে নতুন রক্ত আমদানী করা।

হিন্দু ধর্মের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এটা একদিনে তৈরী হয় নি, এটা যদিও আর্যদের দ্বারা গঠিত, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিতও বটে। নিরোদ সি চৌধুরী তার “Hinduism: A religion to live by” এ খুব স্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করে গেছেন প্রাচীন গ্রীক, রোমান, জার্মান ও পার্সিয়ান ধর্মগুলোর সাথে এর মিল। যা থেকে এটাও প্রমানিত হয় কোনো এক সময়ে এসব ধর্মের লোকেদের পূর্বপুরুষরা একই জায়গায় থাকতেন। এরপর একের পর এক ভারতবর্ষ যখন বাইরে থেকে আক্রান্ত হয়েছে হিন্দু সমাজ ঠিকই আগন্তুকদের নিজেদের সমাজে গ্রহণ করে নিতে পেরেছে। আর এই জন্যেই প্রাচীন গ্রীক, রোমান, জার্মান ও পার্সিয়ান ধর্মগুলো পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেলেও হিন্দু ধর্ম ঠিকই টিকে আছে। আর এটা সম্ভব হয়েছিল বহিরাগতদের গ্রহণ করার কারণে। পার্সিয়ান ধর্মগুলো এখনো জীবিত – তবে তার জন্ম ভূমিতে নয়, ভারতবর্ষের মাটিতে। তাই যারা বলেন হিন্দু হওয়া যায় শুধু জন্মসুত্রে তারা ধর্ম সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের অভাব থেকেই বলেন। এক সময় ইহুদিরা তাদের যাতে শরীরিকভাবে ধ্বংস না হতে হয়, সেজন্যে নিয়ম করেছিল ইহুদি নারীর সন্তান মানেই ইহুদি। তাহলে আমরা কি বলতে পারি না, বাবা মা একজন হিন্দু হলেই ছেলেমেয়ে হিন্দু হবে? এতে আর যাই হক, হিন্দু মেয়েদের ঘর থেকে বের করে নেবার হিড়িকটা কমবে। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় এটা একটা সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে। একই সাথে অন্য ধর্মের যে সব লোকজন হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে চায়, তাদেরও গ্রহণ করার ব্যবস্থা করা দরকার। আমাদের তো মানতেই হবে, ধর্মের অনেক আগে মানুষের আবির্ভাব এই জগতে, আর তারও আগে জন্ম নিয়েছে পৃথিবী। জানিনা ঠিক কবে থেকে শুধুমাত্র জন্মসুত্রে হিন্দু হওয়া যায় এ নিয়ম চালু হযেছে, তবে এটা যে গোড়ার দিকে ছিলো না, সেটা ঠিক। আর এ কারণেই ইসলাম এ দেশে আসার আগ পর্যন্ত প্রায় সমস্ত গোষ্ঠিকে হিন্দুরা গ্রহণ করেছে। হিন্দু রাজারা যখন দক্ষিন এশিয়া বিজয় করেন, সেই জাভা, সুমাত্রা, কালিমান্তান, বালি এসব জায়গায় নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন স্থানীয় লোকরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ না করলে সেটা সম্ভব হত না, যেমনটা হতনা ইসলামের পক্ষে ভারত জয় করা, যদি না স্থানীয় জনগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত। আর এটা হযেছে শুধু মাত্র ইসলামের অভ্যন্তরীণ সাম্যের কারণে।

ইদানিং কালে প্রায়ই এরকম খবর দেখা যায় - এতজন হিন্দু ধর্মত্যাগ করল। অনেকেই বলেন এটা জোর করে বা লোভ দেখিয়ে করা হয়। কথাটা আংশিক সত্য। আসলে এই ধর্মান্তরের ঘটনাটা অধিকাংশ সময়েই ঘটে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ক্ষেত্রে আর এটা ঘটে তাদের উপর উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের অত্যাচার আর অবহেলার কারণে। রাশিয়াতে প্রায়ই বলে হিন্দি-রুশী ভাই ভাই। অনেক ক্ষেত্রে ওরা হিন্দি বলতে যেমন ইন্ডিয়ান বোঝায়, তেমনি আবার হিন্দুদেরও বোঝায়। হাসি। ভাবি হিন্দু – হিন্দু ভাই ভাই হয় না, হিন্দু – রুশী ঠিকই হয়। দেশেও হিন্দু – মুসলিম ভাই ভাই কথা আছে, তারা হতেও পারে – যেমন হয়েছিল ১৯৭১ সালে, তবে উচ্চ আর নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা কখনই ভাই হতে পারেনি, আর এ জন্যেই হিন্দু সমাজের অবক্ষয় রোধ হয়নি কোনদিন। আমরা যতদিন সমাজ থেকে এই বর্ণ প্রথা উঠাতে না পারব, সমাজের অবক্ষয় কেউই রোধ করতে পারবে না। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, ইসলাম বা খ্রীস্টান ধর্মের অভ্যন্তরীণ সাম্যের আবেদন অনেক জোরালো। বিশেষ করে ইসলামের। এটা অনেকটা আমেরিকান গণতন্ত্রের মতো। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের তুলনা হয়না, আবার এরাই নির্দ্বিধায় অন্য দেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে নিজেদের স্বার্থের জন্য। উগ্র ইসলামেরও এক অবস্থা। এরা একে অন্যের জন্য জীবন দিতে পারে, অথচ অন্য ধর্মের লোকজনদের তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে রাজী নয়। আর আমেরিকা যেমন এটা করে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, অন্যান্য ধর্মের লোকেরা ঠিক সেভাবেই হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদের সুযোগ নেয়। আমার অবাক লাগে যেখানে এক বাড়ীতে কেউ শিবের ভক্ত, কেউবা কৃষ্ণের, আবার কেউ শক্তির এবং এ নিয়ে তাদের কখনই ভেদাভেদ হয়না, এরাই কিনা বাইরে গিয়ে মানুষে মানুষের এত ভেদাভেদ দেখতে পায়। ইসলাম বা খ্রীস্টান ধর্মে এক ঈশ্বর (যদিও খ্রীস্টান ধর্মে ট্রিনিটি) অথচ এর আচরণকে কেন্দ্র করে অনেক অনেক আন্টাগনিস্টিক ভাগ, হিন্দুদের বহু দেবতা, তবে ধর্ম কেন্দ্রিক আন্টাগনিস্টিক ভেদ ততটা প্রকট নয়। এর বিপরীতে সমষ্ঠিগতভাবে ওদের ঐক্য হিন্দুদের থেকে অনেক বেশী। তাই যতদিন না হিন্দুরা বর্ণ প্রথা ত্যাগ করছে, ততদিন তাদের পিছিয়ে পড়তে হবে সব জায়গাতেই।

এবার আসি মেয়েদের কথায়। মেয়ে – কে সে? জীবনের প্রথম মহিলা, এটা মা। তার পর বোন। এরপর স্ত্রী আর সব শেষে কন্যা। আমরা কি কখনো ভেবে দেখি, এই যে মহিলারা, যারা আমাদের সব চেয়ে আপন জন, যাকে ছাড়া আমাদের জন্ম হতনা, হতনা আমাদের বংশ রক্ষা, তারা কতটা অসহায়? হিন্দু আইনে তারা কোন কিছুরই অধিকার পান না, না মা হিসেবে, না স্ত্রী হিসেবে, না কন্যা হিসেবে। আমরা কি পারি না নিজেরা এটার পরিবর্তন করতে? আমরা কি পারি না বলতে যে আমাদের মত মেয়েরাও বাবার সম্পত্তির ভাগ পাবে? তাহলে হয়তো যৌতুক ব্যাপারটার গুরুত্ব কমে যাবে। এ ব্যাপারে আসলে সরকার থেকেই উদ্যোগ নেয়া দরকার। এটা কেমন করে হয় যে দেশের জনগোষ্ঠির এক বিশাল অংশ আইনগত ভাবে সমস্ত অধিকার বঞ্চিত? আমরা যদি আমাদের মা, বোন, স্ত্রী আর কন্যাকে আইনগত ভাবে আমাদের সম্পত্তির অধিকার দেই, এটা শুধু তাদের জন্যই নয়, সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। আর সময়ের সাথে পা মিলিয়ে আমাদের সমস্ত বিবাহের আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। আমরা হিন্দু সমাজে বাস করলেও আমাদের জীবনের সব কিছুই চলে রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী। তাই বিবাহ ধর্মীয় নীতিতে হলেও তার আইনগত রূপ দিতে হবে রেজিস্টির মাধ্যমে। কেননা ধর্মীয় বিবাহে দায়বদ্ধতা শুধুই মৌখিক, তা পালন করা না করা নির্ভর করে বিবেকের উপরে, আর আজ কাল এটার খুবই অভাব। এ ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের এগিয়ে আসা উচিত, এবং রাষ্ট্রীয় ভাবে বাধ্যতামূলক বিয়ে রেজিস্টির সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

এখানে শুধু তিনটি বিষয়ের উপরে সংক্ষেপে লিখলাম। সমস্যা অনেক। তা নিয়ে ভাবতে হবে, সমাধানের পথ খুজতে হবে। তবে ধীরে ধীরে। আপনারা কি বলেন?

দুবনা, ০৭ মে ২০১৪

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি

স্মৃতি